ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক,নারায়ণগঞ্জ প্রতিদিন ডট কম : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার দুপুরে পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিবাদে বাংলাদেশ বলেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত দুজনের ফাঁসি নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদপত্র তুলে দেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মিজানুর রহমান।
এদিকে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় গতকাল সোমবার ‘কালো দিবস’ পালন করে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামি। দেশটির আরেকটি রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফের এক নেতা পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে এ দুজনের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রকাশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দোষী সাব্যস্তদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা পাকিস্তান আবার স্বীকার করে নিচ্ছে। পাকিস্তানের এ অবস্থান একদিকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যাকে অস্বীকার; অন্যদিকে চার দশক আগে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার নিশ্চিত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধে বাংলাদেশের প্রয়াসের অব্যাহত বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তান সরকার গত রোববার এক বিবৃতিতে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান বলেন, ১৯৭১ সালে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
প্রতিবাদপত্রে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি নিয়ে খণ্ডিত ব্যাখ্যা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুপ্রতিবেশী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হচ্ছে চুক্তির মূলনীতি। ওই চুক্তিতে কখনোই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত এবং এর পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি কিংবা বিচার থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলা হয়নি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের যে দায়িত্ব ছিল, সেটি পালনে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাকিস্তান তার দায় এড়াতে পারে না।
পাকিস্তানের কাছে দেওয়া প্রতিবাদপত্রের শেষে বলা হয়েছে, সরকারের অব্যাহত অনুরোধের পরও ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার নিয়ে পাকিস্তানের অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় গভীর নিন্দা জানায় বাংলাদেশ। এটি দুই দেশের কয়েক দশকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয়। তাই এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে পাকিস্তানের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ এটাও আশা করে যে পাকিস্তান দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবে।
গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানান হাইকমিশনারের কাছে। বেলা আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত স্থায়ী ওই আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদপত্র হাইকমিশনারকে দেওয়া হয়।
পরে মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, হাইকমিশনারের কাছে তাঁদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তাঁদের বিবৃতি যে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, সেটিও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের একটি প্রতিবাদপত্র হাইকমিশনারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর গত রোববার দুপুরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিবৃতি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পর এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর জন্য গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে। সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
পাকিস্তানের মুখপাত্রের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৭১-এর ঘটনাবলি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি, তা আগের মতো আবার গুরুত্ব দিচ্ছি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে বিবৃতি প্রচারের পর একই দিন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান ও পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির সিরাজুল হক বিবৃতি দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, শুধু পাকিস্তান নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে কোনো দেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ মেনে নেবে না।
পাকিস্তানে ‘কালো দিবস’ পালন: সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় গতকাল ‘কালো দিবস’ পালন করে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামি। সে দেশের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামির আমির সিরাজুল হক গতকাল বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র ও এর আদর্শের প্রতি ভালোবাসার জন্যই এ দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বান্নুতে এক জনসভায় সিরাজুল হক বলেন, এ দেশ (পাকিস্তান), এর আদর্শ, এর সেনাবাহিনীর প্রতি ভালোবাসাই ছিল এ দুজনের (সাকা ও মুজাহিদ) আসল অপরাধ।
দুজনের ফাঁসির পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান নীরব থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিরাজুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে দেশের পাকিস্তানপন্থী মানুষদের নির্মূল করছেন।
এদিকে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের পাঞ্জাব প্রদেশের নেতা মিয়া মেহমুদ রাশিদ গতকাল সেখানকার প্রাদেশিক পরিষদে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তানের ভাবাদর্শের সমর্থকদের ধারাবাহিকভাবে ফাঁসি কার্যকর করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) এ বিষয়টি উত্থাপনের জন্য তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান।
Leave a Reply