বাংলাদেশের ফিনিশড চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা কমছে বিশ্ববাজারে। বিদেশী ব্র্যান্ড ক্রেতারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের চামড়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এ পণ্যের বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলোর ক্রেতারাও ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। যে পরিমাণ রফতানি হচ্ছে, তারও কাঙ্ক্ষিত দাম মিলছে না। আবার দেশে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব শিল্প নগরীতে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির ঘাটতিও সময়ের বড় বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। স্থানান্তরের মধ্যদিয়ে কবে নাগাদ বিশ্ববাজারের এই শিল্পের প্রতি ক্রেতাদের সুদৃষ্টি ফিরবে সেই পূর্বাভাসও নেই। বরং আছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার উপর্যুপরি হুমকি। এছাড়া দেশে চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতের সব স্তর এমনকি রফতানি পর্যায়েও বিশৃংখলা চলছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাবে এ দেশের প্রক্রিয়াজাত ফিনিশড চামড়ার আধিপত্যও বিশ্ববাজারে কমে গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটা সময় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে এই চামড়াই শুধু রফতানি হতো। বর্তমানে ‘স্বল্প প্রক্রিয়াজাত ভেজা চামড়া’ বা ওয়েট ব্লু লেদার রফতানির সরকারি অনুমোদন নেই। এতে করে দেশের বিপুল পরিমাণ চামড়া সম্পদের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর জন্য বিদেশে বাণিজ্যিক উইং ও দূতাবাসগুলোও কাজ করছে। তারা দেশ ও পণ্যভিত্তিক বাজার সম্ভাব্যতাও যাচাই করছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি গতিশীল এবং দেশের বৃহৎ স্বার্থরক্ষায় করণীয় সবকিছুই করা হবে। এক্ষেত্রে ওয়েট ব্লু লেদার রফতানি আবার চালুর অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি যৌথ সিদ্ধান্তের বিষয় জানিয়ে তিনি বলেন, যৌক্তিকতা খুঁজে পেলে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে ব্যবস্থা নেবে সরকার।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চামড়া শিল্পখাতে কমপ্লায়েন্স শৃংখলা না থাকায় দেশে দীর্ঘ বছর ধরেই এ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। এরাই এখন এই শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে বিশ্ববাজারে সৃষ্ট বিশাল সম্ভাবনার দরজা তাদের অবহেলা ও অতিমুনাফার কারণে নষ্ট হতে যাচ্ছে। একই কারণে দেশ থেকে ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানিও স্থগিত হয়ে গেছে। যদিও বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের সিংহভাগ ব্যবসায়ীর দাবির মুখে তা আবার রফতানির অনুমোদনের উদ্যোগ নিলেও সেটি ওই সিন্ডিকেটের বাধার কারণে আর আলোর মুখ দেখেনি।
এ প্রস্তাব প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, রফতানির দ্বিতীয় বৃহৎ খাত হচ্ছে চামড়া শিল্প। কিন্তু এ শিল্পের সম্ভাবনা নষ্ট করছে বিদ্যমান নানা বিশৃংখলা। স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতের সব স্তর শেষে রফতানি পর্যায়েও এই বিশৃংখলার রাহুমুক্ত নয়। এ খাতের বিভিন্ন স্তরে সৃষ্ট শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নানা কারসাজি ও অতি মুনাফাই এর জন্য দায়ী। তিনি দাবি করেন, এরা এতটাই শক্তিশালী যে, সরকারের ধমক, হুশিয়ারি কিংবা আলটিমেটাম কোনোটাতেই তাদের বশে আনা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রায় দেড় যুগের চেষ্টায়ও এই শিল্পটি এখন পর্যন্ত পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব শিল্প নগরী সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের চেষ্টা সফল হয়নি। এতে বিশ্ববাজারে দেশীয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা কমছে এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আবার পণ্যমূল্য কমে যাওয়ায় দেশ কাক্সিক্ষত বৈদেশিক মুদ্রা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাভারের বিসিক চামড়া শিল্প নগরীতে পরিপূর্ণ স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত দেশের স্বার্থে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তিনি এই ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানান। কারণ সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, আগামী তিন বছরেও তা সাভারে পরিপূর্ণ স্থানান্তর সম্ভব হবে না।
ওদিকে চামড়া শিল্প নগরী স্থানান্তর প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর হাজারীবাগে কোনো ট্যানারি থাকতে পারবে না। এ সময়ের মধ্যে ট্যানারি স্থানান্তর না করলে সংশ্লিষ্টদের বরাদ্দকৃত প্লট বাতিল করে দেয়া হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে এর পর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোতেও গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিসও বন্ধ করে দেয়ার শক্ত অবস্থানের কথাও তিনি জানান। সাভারে বাস্তবায়নাধীন ‘চামড়া শিল্পনগরী, ঢাকা’ প্রকল্পের সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ডসহ অন্যান্য নির্মাণ কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আয়োজিত সভায় শিল্পমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।
ওয়েট ব্লু অনুমোদন দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে চামড়া ব্যবসায়ীদের ওই প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, আধুনিক চামড়া শিল্প গড়ে তুলতে সরকার ট্যানারি মালিকদের শিল্প ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থও পরিশোধ করেছেন। তবু যেন চামড়া শিল্প উন্নয়নে কোনো অগ্রগতি নেই। যদিও কিছু কিছু ট্যানারি মালিক দ্রুত স্থানান্তরের পক্ষে। তবে অনেকেরই এখন পর্যন্ত বাউন্ডারি সীমানার কাজ শেষ হয়নি। আবার হাজারীবাগের পুরনো ট্যানারিগুলো মেরামত করেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যাচ্ছে না সেই হেমায়েপুরে স্থানান্তরের আশায়। এর নেতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে চামড়া রফতানিতে পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় দেশীয় মূল্যবান বিপুল পরিমাণ চামড়া সম্পদের ভবিষ্যৎ কী হবে এই নিয়ে কারও ভাবনা নেই। অবহেলায় ও অযত্নে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর দায় কার?
Leave a Reply