সূত্র জানায়, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিকে অনুকূল বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের জন্য নতুন বছরকে মোক্ষম সময় বলে ধরে নিচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বাংলাদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গি তৎপরতায় জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ফ্রান্সের প্যারিসে মৌলবাদী সংগঠন আইএস তিন স্থানে বোমা হামলা এবং গুলি করে নিরীহ ১৩২ মানুষ হত্যা করেছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইএস তাণ্ডব চালাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে হামলা চালানোর। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বজনমত এখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। এ সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েই আছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের পাঁচটি রায়ে জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করেছে। এটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থায় আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দলটিকে দ্রুত নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা চাই জনগণের ইচ্ছানুযায়ী যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হোক। যত দ্রুত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত কি জানতে চাইলে হানিফ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হবে।
নেদারল্যান্ডস সফর শেষে ৮ নভেম্বর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কি জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনসহ বিভিন্ন আইনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সুযোগ রয়েছে। এখন সরকার ইচ্ছে করলেই সংবিধান ও আইনের বিধান প্রয়োগ করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা।
আইনজীবীরা মনে করেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধের দুটি উপায় রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রশাসনিক আদেশ এবং অন্যটি বিচারের মাধ্যমে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের (গ) ও (ঘ) উপ-অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যায়। এজন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ ‘তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।’
এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে এই চারটির যে কোনো একটি অথবা সবগুলো অভিযোগই আনতে পারে সরকার। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের পাঁচটি রায়ে জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বশেষ গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দিয়ে ঘোষিত রায়ে, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পদ থেকে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের সরিয়ে দিতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে অভিমত দেয়া হয়। অভিমত দিয়ে বলা হয়, ওই সব জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধী লোক থাকা উচিত হবে না। এর জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়া এ রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ বলা হয়। রায়ে আরও বলা হয়, নতুন প্রজন্ম মনে করে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের ভূমিকা এবং এর ৪২ বছর পরও তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। এটি জাতির জন্য উদ্বেগজনক। রায়ে বলা হয়, ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ওই দলটির সদস্যদের মনোভাব পরিবর্তনের কোনো প্রমাণ নেই।
আইনজীবীরা মনে করেন, ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। এই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ধর্মের নামে বা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গড়া কোনো সংগঠন, ইউনিয়ন বা গোষ্ঠীর সঙ্গে কেউ যুক্ত হতে পারবে না। এ ধরনের সংগঠনকে সরকার গেজেটের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে পারবে। সরকার ওই সংগঠনের সমূহ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ ধরনের কার্যক্রমে আবার কেউ যুক্ত হলে তাকে ৩ বছরের জেল অথবা জরিমানা বা দুটিতেই দণ্ডিত করা যাবে’।
এর বাইরে আছে সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ (২০০৯ সালের ১৬ নাম্বার আইন)। এই আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত আছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, আদেশ দ্বারা, তফসিলে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করতে পারবে।’ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাজেই এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগে কোনো বাধা নেই।
এদিকে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতের বিচারেরও সুযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালে সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইনে ব্যক্তির বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও কোনো সংগঠনের বিচারের সুযোগ ছিল না। এজন্য ২০১১ সালে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে। যদিও সে তদন্ত আজও আলোর মুখ দেখেনি।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪০ সালের ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী তিন দফায় নিষিদ্ধ হয়েছিল। আর দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক দলের অধ্যাদেশের মাধ্যমে দলটি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াত নিষিদ্ধ ও একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রথম বাংলাদেশে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নিজেরাও বিরোধী দলে থাকার সময় এ দাবিতে সোচ্চার ছিল। তাদের আদর্শিক মিত্র ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য চাপ রয়েছে। সিপিবি-বাসদসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবিতে তারা গত বছর হরতাল পালন করে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ এ দাবিতে সোচ্চার।
Leave a Reply