বিশেষ সংবাদদাতা | বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সরকারের রাজস্ব আয়। অক্টোবর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। এ হিসাব গত বুধবারের। মঙ্গলবার পর্যন্ত ঘাটতি আরও সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা বেড়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। যদিও এ নিয়ে অবলম্বন করা হচ্ছে কঠোর গোপনীয়তা। রাজস্ব বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই জানেন না এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি কি। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া এনবিআরেরই এক গোপন প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস- এই ৩টি খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি হয়েছে। চলতি জুলাই-অক্টোবর ৪ মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। সাময়িক হিসাবে আদায় হয়েছে ৪১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ শতাংশ আদায় হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। যদিও রাজস্ব বোর্ডের ওপর ২৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে।
সূত্র মতে, রাজস্ব আয়ের চলমান হতাশাজনক চিত্রে অর্থমন্ত্রী এখনও চরম ক্ষুব্ধ। তার অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করছে না এনবিআর- এমন ক্ষোভও তার আছে। বিভিন্ন ফোরামে এর বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছেন তিনি। বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে রাজস্ব প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তার বিরোধ, মানসিক দূরত্ব প্রকট বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। কর্মকর্তাদের হয়রানি ও গ্রুপিং রাজস্ব আদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পরিস্থিতি সামলাতে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তিনি একটি ডিও চিঠিও লিখেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও এনবিআরের চেয়ারম্যান পরিবর্তনে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। তবে অর্থমন্ত্রী কাস্টমস বা আয়কর ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে চান। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এনবিআর চেয়ারম্যান পদে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কাউকে নিয়োগ দেয়ার ঘোরতর বিরোধী। সম্প্রতি এ নিয়ে তারা তাদের আপত্তির কথা সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে জানিয়েছেন বলে সূত্র দাবি করেছে।
সব খাতেই ঘাটতি : এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের সব খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে আদায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ঘাটতি ১৯ শতাংশ বা ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। আয়কর ও ভ্রমণকর খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ২১ শতাংশ বা ৩ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরেই রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১ মাসে ঘাটতি বেড়েছে ২ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। সর্বশেষ চূড়ান্ত হিসাবে তা ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সরকারের জন্য অস্বস্তিকর : অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিষয়টি সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ অনুদান অনেক কমে গেছে। পাশাপাশি এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না, রাজস্ব আয় অনেক বেড়েছে। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন রাজস্ব আয়ে হোঁচট খেল তার কারণ অনুসন্ধান না করা সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে।
এছাড়া সরকারের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল করতে হবে। কিন্তু রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সরকারের দায়দেনা অনেক বেড়ে যাবে। বাজেট ঘাটতিও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, কি কারণে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কোনো অস্থিরতা আছে কিনা তা যাচাইয়ে এখনই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের একাধিক সদস্য জানান, আয়কর আদায়ে এখন লেজেগোবরে অবস্থা। ৪ মাসেই ঘাটতি প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। কোনো কর অঞ্চলই সাফল্য দেখাতে পারছে না। তবে এ মাসে ব্যক্তি শ্রেণীর রিটার্ন দাখিলের পর আদায় কিছুটা বাড়বে। কিন্তু এখনও নীতির পরিবর্তন না হলে আয়করে ঘাটতি এবার অস্বাভাবিকই হতে পারে। তারা বলেন, অসম্মান আর অসন্তোষ নিয়ে কাজ করা যায় না। নীতিনির্ধারণে একনায়কতন্ত্র থাকলে কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি বাড়বে। কিন্তু সরকারের রাজস্ব বাড়বে না। একাধিক কাস্টমস এবং ভ্যাট কমিশনার জানান, সব ক্ষেত্রেই আতংক। সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স কার্ড প্রতি মাসেই তৈরি করে নির্দিষ্ট সময়ে জমা দিতে হচ্ছে। এতে অহেতুক সময় নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার বিশেষ করে এনবিআরে সভার নামে সকাল ১০টা থেকে রাত পর্যন্ত উপস্থিতি অসহনীয়। যারা ঢাকার বাইরে থেকে আসেন তাদের ভোগান্তি বেশি। এনবিআর চেয়ারম্যান বিকালে অফিসে এসে গভীর রাত পর্যন্ত অফিস করেন। এ নিয়ে সর্বত্র তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। এছাড়া ফেসবুক এবং ইমেইলের দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হয় কখন কি নির্দেশনা আসে। প্রতিযোগিতা থাকে কার আগে কে ফেসবুকে লাইক বা তোষামোদি করতে পারে। তারা স্বীকার করেন, এসব কারণে এখন কর্মকর্তাদের রাজস্ব আদায়ে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে নিজেদের কর্মস্থল বা চাকরি বাঁচাতেই তটস্থ থাকতে হয়।
এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্য : এদিকে এনবিআরের প্রতিবেদনে আমদানি-রফতানি খাতে রাজস্ব আয়ে ঘাটতির কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় মোট আমদানি মূল্যে কোনো প্রবৃদ্ধি নেই বরং ৫ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বা ৭ শতাংশ মূল্যের পণ্য কম আমদানি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ও কর মূল্যভিত্তিক হওয়ায় এবং শুল্কযোগ্য পণ্য আমদানি হ্রাস পাওয়ায় আমদানি খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এছাড়া আয়কর খাতে অগ্রিম আয়করের বিপরীতে যে রাজস্ব আদায় হয়, তার ১৪ শতাংশ রাজস্ব আসে আমদানি খাত থেকে। কিন্তু গত বছরের তুলনায় একই সময়ে অগ্রিম আয়করযুক্ত পণ্য প্রায় ১৯ শতাংশ কমেছে। ৫৩বি ধারায় নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্ট রফতানিতে করহার দ্বিগুণ করার ফলে প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় হয়নি। ২৬৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা। এছাড়া আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করায় রিটার্ন দাখিল কম হয়েছে। এতে রিটার্নের ভিত্তিতে প্রদত্ত কর আদায় কমেছে। ভ্যাট খাতে সিগারেট থেকেই সর্বোচ্চ প্রায় ২৮ শতাংশ রাজস্ব আয় হয়। কিন্তু চলতি বাজেটে তামাকজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস করায় এ খাতে রাজস্ব প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিমকার্ড এবং টেলিফোন খাত স্থানীয় ভ্যাট আদায়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত। কিন্তু সিমকার্ডের ট্যারিফ মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক কমানোয় রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া কনক্রিট রেডিমিক্স হতে ভ্যাট অব্যাহতি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও ভেষজ ওষুধের ভ্যাট প্রত্যাহার, অনলাইনে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়কারীর ভ্যাট প্রত্যাহারে এসব খাতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হবে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, অর্থবছরের বাকি সময়ে উপর্যুক্ত কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।
Leave a Reply